ভারতীয় কিষাণ সংঘ'-এর উদ্যোগে পুণ্যশ্লোকা অহল্যাবাঈ হোলকার ও রাণী রাসমণির গৌরব গাথা স্মরণ

'ভারতীয় কিষাণ সংঘ'-এর উদ্যোগে পুণ্যশ্লোকা অহল্যাবাঈ হোলকার ও রাণী রাসমণির গৌরব গাথা স্মরণ

মিলন খামারিয়া, স্বচ্ছ বার্তা -

কলকাতা, ১২ জুলাই। গতকাল 'মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ'-এর আজাদ ভবনে পুণ্যশ্লোকা মহারাণী অহল্যাবাঈ হোলকার ও রাণী রাসমণির গৌরব গাথা স্মরণ করল ভারতীয় কিষাণ সংঘ। সারা দেশ জুড়ে অহল্যাবাঈ হোলকারের জন্মের ৩০০ বছর পূর্তি পালন করা হচ্ছে। পাশাপাশি লোকমাতা রাণী রাসমণির জন্মের ২৮২ বছর চলছে। এই দুই রাণী বিধবা হয়েও রাজ্য তথা নিজের জমিদারী অঞ্চল শাসন করেছিলেন অত্যন্ত সাহস ও দক্ষতার সাথে। তাদের গৌরবের কথায় আলোচনা করল ভারতীয় কিষাণ সংঘ।
এদিন শুরুতে প্রদীপ প্রজ্বলন করে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন ভারতীয় কিষাণ সংঘের কলকাতা জেলার সভাপতি সুবীর রায়চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন ম্যাকাইয়াসের ডিরেক্টর ড. স্বরূপ প্রসাদ ঘোষ, আর.এস.এস.-এর পূর্ব ক্ষেত্র প্রচারক রমাপদ পাল, ভারতীয় কিষাণ সংঘের - উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ক্ষেত্রের সংগঠন সম্পাদক শ্রীনিবাস, পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তের - সভাপতি অনিমেষ পাহাড়ি, সাধারণ সম্পাদক আশিস সরকার, সংগঠন মন্ত্রী অনিল রায় ও মহিলা প্রমুখ ড.অলি ব্যানার্জি; কলকাতা জেলার সম্পাদক দীপান্বিতা মন্ডল, সমাজসেবী রুদ্রনীল ঘোষ, পদ্মশ্রী কাজী মাসুম আক্তার, শিক্ষাবিদ ড. পাপিয়া মিত্র ও আরও অনেকে।

শুরুতেই রমাপদ পাল বলেন, পুণ্যশ্লোকা মহারাণী অহল্যাবাই হোলকার (৩১ মে ১৭২৫ - ১৩ আগস্ট ১৭৯৫) ছিলেন ভারতের মারাঠা মালওয়া রাজ্যের হোলকার রাণী। রাজমাতা অহল্যাবাই মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের জামখেড়ের চোন্ডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৫৪ সালে কুম্ভেরের যুদ্ধে অহল্যাবাঈয়ের স্বামী খান্ডেররাও হোলকার নিহত হন। বারো বছর পর, তার শ্বশুর, মালহার রাও হোলকার মারা যান। এর এক বছর পর তাকে মালওয়া রাজ্যের রাণী হিসেবে অভিষেক করা হয়।

রানী অহল্যাবাঈ ছিলেন হিন্দু মন্দিরের একজন মহান পথিকৃৎ এবং নির্মাতা। তিনি ভারতজুড়ে শত শত মন্দির এবং ধর্মশালা নির্মাণ করেছিলেন। উত্তর হিমালয়ে দুর্গম কেদারনাথ থেকে, বারাণসী, অযোধ্যা, গয়া, পুরী, মথুরা, দ্বারকা, সোমনাথ সহ দেশের দক্ষিণতম প্রান্তে রামেশ্বরম পর্যন্ত তাঁর প্রচেষ্টায় নির্মিত হয়েছিল শত শত মন্দির, সরাইখানা, স্নানঘাট আর জলাশয়। এই বিপুলসংখ্যক মন্দিরগুলি রাণীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় কেবল পূজার্চনাতেই নয় বরং অগণিত দরিদ্র মানুষের রোজকার অন্নসংস্থান ও আশ্রয়দানের কাজেও নিয়োজিত থাকতো।

১৭৬৭ থেকে ১৭৯৫ পর্যন্ত দীর্ঘ তিনদশক ধরে অহল্যাবাঈ সর্বোচ্চ পারদর্শিতা ও প্রজাবৎসলতার সঙ্গে তাঁর রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। রাণীর সুদক্ষ দিশা নির্দেশে অতিদ্রুত মালওয়া এসময় কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে বিকাশের শিখরে পৌঁছায়।

 প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রজাদের কৃষিঋণ মকুব, ভূমিহীন চাষীদের জমির মালিকানা দান, রাজস্ব ব্যবস্থার সরলীকরণ, মুদ্রা ব্যবস্থার উন্নতি, রাজধানীর মহেশ্বরকে বস্ত্রশিল্পের এক প্রধান জাতীয় কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলা, বণিক ও কারিগরদের নানা ভাবে পেশার সুরক্ষাদান, বাণিজ্যের জন্য তথা জনগণের যাতায়াতের সুবিধার্থে স্থল ও জল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি, পথপাশে বিপুল পরিমাণ বৃক্ষরোপণ ও জলাশয় খনন, শাস্তিমুলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সবস্তরের কর্মচারীদের দুর্নীতি দমন, রাজ্যের আয়ব্যয়ের নিখুঁত হিসাবরক্ষা ও রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক সুদৃঢ়করণের মাধ্যমে তিনি বাহ্যিক অরাজকতা স্বত্তেও নিজের শাসনাধীন অঞ্চলকে এক সুখী ও সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত করেন। তাঁর কীর্তি মালওয়া রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে অহল্যাবাঈয়ের বিপুল জনসেবা ও স্থাপত্যকীর্তির উদ্যোগ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। 

ধর্মপ্রাণা অহল্যাবাঈয়ের ব্যক্তিগত জীবন ছিলো পুরোপুরি অনাড়ম্বর। হিন্দু মহিলাদের পর্দাপ্রথা ও সহমরণের ঘোর বিরোধী প্রগতিশীল অহল্যা তাঁর কন্যা মুক্তাবাঈকে সতীদাহের আগুন থেকে বাঁচাতে পারেননি। প্রিয়তমা আত্মজাকে সমাজের এই নৃশংস প্রথার কাছে হারিয়ে অহল্যা গভীর ভাবে ভেঙে পড়লেও মালওয়া রাজ্যের আপামর বিধবা ও অসহায় নারীদের পক্ষে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন সন্তানহারা এই মা। এরপর আজীবন হিন্দুধর্মের মুরুব্বিদের শত বাধা সত্ত্বেও তিনি স্বামীহারা অগণিত মেয়েকে তিনি সহমরণের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এছাড়াও অহল্যাবাঈ তাঁর রাজ্যের বিধবা ও সন্তানহীন নারীদের সম্পত্তি ও দত্তকসন্তান গ্রহণের অধিকারকে মঞ্জুরি দিয়েছিলেন আর কঠোরভাবে সেই সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করতে উদ্যোগীও হয়েছিলেন। 

রাণী অনুভব করেছিলেন, অস্ত্র ও যুদ্ধের মাঝে নয়, হোলকার রাজ্যের সর্বত্র ব্যাপকতম জনকল্যাণের মাধ্যমে অর্জিত জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন ও একনিষ্ঠ ভালোবাসার মধ্যেই নিহিত আছে তাঁর প্রধানতম শক্তি। তাই ১৭৯৭ তে জীবনাবসান পর্যন্ত নিজেকে প্রতিদিন জনসেবাতেই নিয়োজিত রেখেছিলেন তিনি। মালওয়া সহ গোটা দেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর বহুমুখী সংস্কার কার্যাবলী, অজস্র স্থাপত্যকীর্তি, সাংস্কৃতিক অবদান ও সর্বোপরি অপার প্রজাবৎসলতার মাধ্যমে জনমনে তাঁর সম্পর্কে যে অসামান্য শ্রদ্ধাবোধ গড়ে উঠেছিলো, সেসব কিছুর শিকড় আজও, তাঁর রাজত্বকালের তিন শতাব্দী পরেও একইভাবে প্রোথিত। আর ঠিক এই কারণেই মধ্য ও পশ্চিম ভারতের সর্বত্র জনতার মাঝে 'লোকমাতা' নামে আজও গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে পূজিতা হয়ে থাকেন মহারাণী অহল্যাবাঈ হোলকার, বলেন জানান পূর্ব ক্ষেত্র প্রচারক রামপদ পাল।

পাশাপাশি আলোচনা করা হয় 'লোকমাতা রাণী রাসমণি'কে নিয়েও। অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন রাণী রাসমণি, যা নিয়ে আলোচনা করেন রাসমণি গবেষক ডাঃ দুলাল দাস। তিনি একটি বইও লিখেছেন রাণী রাসমণিকে নিয়ে। তিনি বলেন, রাণী রাসমণি তার বিবিধ জনহিতৈষী কাজের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করেন। কলকাতার অধিবাসীদের গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য তিনি কলকাতার বিখ্যাত বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট ও নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেন। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি (অধুনা ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) ও হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠাকালে তিনি প্রভূত অর্থসাহায্য করেছিলেন।

রাণী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির ১৮৫৫ সালে ৩১ মে বৃহস্পতিবারে স্নান যাত্রার পুণ্য তিথিতে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এক লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করে রুপোর রথ বানিয়ে তাঁর গৃহদেবতা রঘুবীর অর্থাৎ শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করেছিলেন। রাণী রাসমণি প্রচলিত সেই রথযাত্রা আজও রথের দিনে দক্ষিণেশ্বরে মহাসমারোহে পালন করা হয়। রথে আরোহণ করে জগন্নাথদেব পুরো দক্ষিণেশ্বর প্রদক্ষিণ করেন।

রুদ্রনীল বলেন, আমরা রাণী অহল্যাবাঈ হোলকারকে নিয়ে একটি নাটক করেছি, কিছুদিন আগেই তা মঞ্চস্থ হয়েছে। তাঁর জীবন ও কীর্তি সমাজের মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

অলি ব্যানার্জি বলেন, আমরা রাজ্যজুড়ে অহল্যাবাঈ হোলকারের জীবনদর্শন ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরছি। আমাদের দেশের নারীরা দুর্বল নয়, তারা অনেক শক্তিশালী, তা যেন নারীরা মনে রাখেন।

'Women Empowerment Foundation'-এর নমিতা নায়েক বলেন, আমরা মেয়েদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছি। আমাদের দেশের নারীরা রাজ্য তথা দেশ শাসন করেছে ও করছে কয়েকশো বছর ধরে। সেখানে আজকের নারীরাও যেন পিছিয়ে না থাকে তার চেষ্টা করছি। 

অনুষ্ঠানে একটি জাতীয়তাবাদী কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'ঝড়ের খেয়া' পাঠ করে শোনান 'স্ফুলিঙ্গ কলাকেন্দ্র'-এর কলাকুশলীরা,পরিচালনায় ছিলেন সংযুক্তা মুখার্জি ভট্টাচার্য।

এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজসেবী - মনোজ সিং, কাকলী মন্ডল, শিপ্রা ঘোষ। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তের অফিস সেক্রেটারি প্রসেনজিৎ নাথ ও সুবীর রায়চৌধুরী। সমগ্র অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন কলকাতা জেলার অফিস সেক্রেটারি শুভজিৎ দাসগুপ্ত।

Comments